মেথি! আমাদের দেশ শুধু নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে বহুল পরিচিত একটি নাম। এটি স্বাদে ঈষৎ তিতা হলেও মানব শরীরের অনেক উপকারে আসে। প্রাচীনকাল থেকেই ভেষজ চিকিৎসক ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মেথির ব্যবহার বহুল পরিচিত। নানা রোগ-বালাই থেকে মুক্তি লাভে মেথি অনেক কার্যকর। এটি একই সাথে মসলা, খাদ্য ও পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া রূপচর্চায়ও মেথির নানা ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মেথির এসকল বহুবিধ ব্যবহার একে অন্যতম সুপার ফুড হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে ব্যাপক সহায়তা করেছে। চলুন জেনে নেয়া যাক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই অন্যতম সুপার ফুডের ভূমিকা সম্পর্কে।

মেথির পুষ্টি উপাদান

মেথিতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, আয়রন, ফ্যাট, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়াম। এছাড়া এতে অল্প পরিমাণে বায়োটিন, কোলিন, ইনোসিটল, জিংক, বি-ভিটামিনস, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ফোলেট ছাড়াও আইসোলিউসিন নামক এক ধরণের এমাইনো অ্যাসিড রয়েছে।

মেথির যত উপকারিতা

নিচে মেথির বিশেষ বিশেষ সাতটি উপকারী দিক তুলে ধরা হল –

১। ওজন হ্রাস করে মেথি

মেথি প্রাকৃতিক ফাইবার থেকে জন্ম বলে তা ওজন কমাতে বেশ কার্যকরী। তাই শরীরের ওজন কমাতে অনেকেই ডায়েটে মেথি রাখে। নিয়মিত এক গ্লাস পরিমাণ গরম পানিতে এক চা চামচ মেথিগুঁড়া ভালভাবে মিশিয়ে খেলে দেখবেন যে আপনার ওজন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। মেদ এবং ওজন কমাতে মেথির জুড়ি নেই। খাবার রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন মেথিযুক্ত বাদাম তেল বা আমন্ড তেল।

২। বদহজম ও অ্যাসিডিটি নিরাময়ে মেথি

মেথি অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ও ফাইবার সমৃদ্ধ, যা শরীর থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর টক্সিন দূর করতে সহায়তা করে। এটি বুকে বা পেটের ওপরের দিকে গ্যাস্ট্রিক/ এসিডের ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়। পাশাপাশি বদহজমের সমস্যাও দূর করতে দারুণ কার্যকর। পেট ও পাকস্থলীর যাবতীয় সমস্যা দূর করতে মেথি গুঁড়া মেশানো পানি নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ুন, সুস্থ থাকুন।

৩। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে

ডায়াবেটিক রোগীদের মেথি এক প্রকার শ্রেষ্ঠ পথ্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিসের রোগীরা নিয়মিত মেথি খেলে তাদের রক্তে চিনির মাত্রা কমে যায়, ডায়াবেটিসজনিত রোগ কম হয় এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। মেথিতে বিদ্যমান গ্যালাক্টোম্যানানের প্রভাবে দেহে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং খুব সহজে বাড়তেও পারে না। সেই সঙ্গে মেথির অ্যামাইনো অ্যাসিড অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন ক্ষরণে ব্যাপক সহায়তা করে। এতে দেহে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৪। জ্বর ও সর্দি-কাশি ভাল করে

জ্বরের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে লেবুর রস ও মধুর সাথে এক চা-চামচ মেথি গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়া শুরু করুন। মেথিতে মুসিলেজ নামের এক ধরণের যৌগ রয়েছে যা গলার খুসখুসে ভাব দূর করে সর্দি-কাশি ভাল করে।

৫। নারীদের ঋতুস্রাবের কষ্ট কমায়

ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের মেথি খাওয়ার প্রচলন বহুকাল আগে থেকেই। মেথিতে থাকা যৌগ এই সময়কার পেটের যন্ত্রণা কমাতে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া, নারীদের স্বাস্থ্যগত বিষয়েও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। মেথিতে রয়েছে সাইটো-ইস্ট্রোজেন, যা নারীদেহে প্রোলাকটিন নামের হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোন নারীদেহকে সুগঠিত করে তুলতে সাহায্য করে।

৬। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে মেথি

রূপচর্চায় মেথির ভূমিকা অপরিসীম। মেথিতে বিদ্যমান ভিটামিন সি ও ভিটামিন কে ত্বকের ছোপ ছোপ দাগ এবং বয়সের রেখা দূর করতে সহায়তা করে। এক চামচ মেথিগুঁড়াকে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে সেটিকে ফেসিয়াল মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করে কিছুক্ষণ রেখে ভাল করে মুখ ধুয়ে নিন। নিয়মিত এই পেস্টটি ব্যবহারে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে।

৭। চুলপড়া ও অকালপক্বতা রোধ করে

স্বাস্থ্যহীন চুলের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে মেথি অনেক উপকারী। নারিকেল তেলের মেথি গুঁড়া মিশিয়ে চুলে মাখলে চুল পরা বন্ধ হয়।। অকালে চুল পাকার হার কমাতেও মেথি খুব কার্যকর। আমলার রসের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ মেথি গুঁড়া মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে গোসলের এক ঘণ্টা আগে স্ক্যাল্প ও চুলে ভাল করে লাগিয়ে নিন। তারপর হাল্কা শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলুন। এতে চুলের অকালপক্বতা রোধ হবে।

মেথি চুলে কীভাবে ব্যবহার করবেন?

মেথির পুরোগুণ পাওয়ার জন্য হেয়ার প্যাক বানিয়ে সপ্তাহে অন্তত: একদিন লাগাতে পারেন। চুলের যত্নে এ হেয়ার প্যাক অনেক কার্যকরী। মেথির দানার পেস্ট বানিয়ে সেই হেয়ার প্যাক আপনার চুলে লাগান। একই সাথে স্ক্যাল্পেও লাগিয়ে নিতে হবে। এছাড়াও, আপনি মেথির তেল ব্যবহার করতে পারেন। মেথির তেল আপনার স্ক্যাল্প ও চুলের জন্য খুবই ভালো। চাইলে মেথিযুক্ত আমন্ড তেল বা বাদাম তেল ব্যবহার করতে পারেন।

কীভাবে বাড়িতেই বানাবেন মেথির তেল (Methi Oil)?

  • আধ কাপ পরিমাণ মেথির দানা নিন। তা গুঁড়ো করে নিতে পারেন কিংবা মেথির দানা গোটাও রাখতে পারেন।
  • এরপর যেকোন একটি প্রাকৃতিক তেল যেমন-নারিকেল তেল, জোজোবা অয়েল, আমন্ড অয়েল বা বাদাম তেলও ব্যবহার করতে পারেন। এই তিনটি আপনার চুলের জন্য খুবই ভালো। একট কাঁচের শিশিতে এই তেল ও মেথির দানা একত্রে মিশিয়ে দিন।
  • এবার ওই শিশির ঢাকনা আটকে নিন। খেয়াল রাখবেন, ওই শিশিতে যেন কোনওভাবেই বাইরে থেকে বাতাস না ঢোকে। এই শিশি ৩ দিন একটি জায়গায় রেখে দিন। ধীরে ধীরে ওই তেলের রং বদলাতে থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গাঢ় হবে তেলের রং।
  • এবার পাতলা একটি সুতির কাপড় ব্যবহার করে সেই তেল ছেঁকে নিতে হবে। আপনার মেথির তেল তৈরি। এটি অন্য একটি কাঁচের শিশিতে ঢেলে রাখুন। সময় মতো ব্যবহার করুন।

পরিশেষে

মেথিকে এটির বহুবিধ ব্যবহারের কারণে সুপার ফুড বলা হয়ে থাকে। এটি স্বাদ ও সুগন্ধির জন্য খাবারে ব্যবহার করা যায়। উজ্জ্বল ত্বক ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুলের জন্য ব্যবহার করা যায়। আবার পথ্য হিসেবেও নানা রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও ব্যবহার করা যায়। এরকম নানা গুণের কারণে এটিকে অন্যতম সুপার ফুড বলা হয়। তাই সুস্থ থাকতে নিয়মিত মেথি খাওয়া উচিত এবং মেথি সমৃদ্ধ তেল রান্না ছাড়াও ত্বকের নানাবিধ সমস্যায় ম্যাসাজ বা মাথার ত্বকের সমস্যায় চুলে ব্যবহার করতে পারেন। শরীরের প্রয়োজনে এক্ষেত্রে ভরসা রাখতে পারেনে মেথিযুক্ত উৎসাহ আমন্ড হেয়ার তেল এবং উৎসাহ মেথি গুঁড়ায়। এটি সরাসরি প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে কোন প্রকার প্রিজারভেটিভ ছাড়াই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। তাই, আপনার ও আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্যে উৎসাহ মেথি গুঁড়া বা উৎসাহ আমন্ড হেয়ার অয়েল ব্যবহারের অভ্যাস করুন আর সুস্থ থাকুন প্রতিদিন।

স্ক্যাল্পে কোনও গুরুতর সমস্যা থাকলে বা চিকিৎসা চললে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে কোনও ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করবেন না।

ডিসক্লেইমার: এই প্রতিবেদনটি কেবলমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য। এটি কোনও ওষুধ ও চিকিৎসার অঙ্গ নয়। আরও বিস্তারিত জানতে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন

Tags:

Leave a Comment

Your email address will not be published.

0
X